
বর্ষঃ ২ সংখ্যাঃ ৩
মার্চ, ২০২৫
রুকূ পেলে রাকাআত হবে কীনা (পর্ব ২)
আহমাদুল্লাহ সৈয়দপুরী
মূল: শাইখ যুবায়ের আলী যাঈ
Views: 85
দলীল ৮:
ইমাম ইবনু আবী শায়বাহ রহিমাহুল্লাহ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রুকূতে চলতে চলতে কাতারে শামিল হয়ে যেতেন।১
তাহকীক: এই বর্ণনাটির সনদ ইবনু তামীমের কারণে যঈফ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই বর্ণনার সাথে রুকূ পাওয়া ব্যক্তির কোন সম্পর্ক নেই।
দলীল ৯:
ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ সাহাবী আবূ বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রুকূ রত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে কাতারে শামিল হয়ে গিয়েছিলেন।২
তাহকীক: এ হাদীসের সনদটি তাদলীসে তাসবিয়াকারী রাবী ওয়ালীদ বিন মুসলিম রহিমাহুল্লাহর তাদলীসের কারণে এবং আবূ বকর বিন আব্দুর রহমান হারিস রহিমাহুল্লাহর ইনকিতার কারণে যঈফ। ‘তিনি যায়েদ বিন সাবিত হতে এই বর্ণনাটি নিয়েছেন’- দাবীটি দলীলবিহীন।
দলীল ১০:
মুসনাদে আহমাদে এসেছে যে, আবূ বাকরাহ রাযিআল্লাহু আনহু রাকাআত পাওয়ার জন্য রুকূ রত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে জামাআতের মধ্যে এসেছিলেন।৩
তাহকীক: এই বর্ণনাটির সনদ বাশশার বিন আব্দুল মালিক আল খাইয়াত আল মুযানী রহিমাহুল্লাহ কারণে যঈফ। এজন্য ‘এ হাদীসের সনদ হাসান’ বলা ভুল। রাবী বাশশার রহিমাহুল্লাহকে ইমাম ইবনু মাঈন রহিমাহুল্লাহ যঈফ বলেছেন। আর সনদের ইত্তিসালের মধ্যেও আপত্তি রয়েছে।
দলীল ১১:
কিছু মানুষ বলেন যে, তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব রহিমাহুল্লাহ, তাবেঈ মায়মূন রহিমাহুল্লাহ এবং তাবেঈ শাবী রহিমাহুল্লাহ "রুকূ পেলে রাকাআত পাওয়া হয়ে যায়"-এর প্রবক্তা ছিলেন।৪
তাহকীক: তাবেঈনদের এই আসারটি সাইয়েদুনা আবূ হুরায়রা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু প্রমুখের আসার ও মারফূ হাদীসের সার্বজনীন অর্থের বিরোধী হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যাত।
দলীল ১২:
ইমাম তাবারানী রহিমাহুল্লাহ সাইয়েদুনা আলী বিন আবী তালিব রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং সাইয়েদুনা ইবনু মাসঊদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, “যে ব্যক্তি রুকূ পেলো না, সে যেন সিজদাকে রাকাআত হিসেবে গণ্য না করে”।
তাহকীক: এই আসারটি সহীহ সনদে প্রমাণিত নেই।
দলীল ১৩:
একটি বর্ণনায় এসেছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا تُبَادِرُونِي بِرُكُوعٍ ، وَلَا بِسُجُودٍ ، فَإِنَّهُ مَهْمَا أَسْبِقْكُمْ بِهِ إِذَا رَكَعْتُ تُدْرِكُونِي بِهِ إِذَا رَفَعْتُ ، إِنِّي قَدْ بَدَّنْتُ-
“আমার পূর্বে তোমরা রুকূ-সিজদা করবে না। আমি তোমাদের পূর্বে যতটুকু রুকূ করবো এবং এরপর যখন আমি মাথা উত্তোলন করবো, নিঃসন্দেহে তোমরা সেটুকু আমার সাথে পেয়ে যাবে। কারণ আমার শরীর ভারী হয়ে গেছে ।”৫
তাহকীক: এ বর্ণনাটি রুকূ পাওয়ার দলীল নয়, তারপরও আইনী হানাফী রহিমাহুল্লাহ একে স্বীয় দলীল সমূহের মধ্যে পেশ করেছেন।৬
দলীল ১৪:
ইমাম ইবনু আবী শায়বাহ রহিমাহুল্লাহ তাবেঈ উরওয়া ইবনু যুবায়ের রহিমাহুল্লাহ এবং সাহাবী যায়েদ বিন সাবিত রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, তারা দুজন যখন ইমামকে রুকূতে পেতেন তখন দুটি তাকবীর দিতেন; একটি তাকবীরে তাহরীমার, অপরটি রুকূর তাকবীর।৭
তাহকীক: এই বর্ণনাটি ইমাম যুহরী রহিমাহুল্লাহর তাদলীসের কারণে যঈফ। আর এটি রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যাওয়ার দলীল নয়।
দলীল ১৫:
ইমাম ইবনু আবী শায়বাহ রহিমাহুল্লাহ তাবেঈ মুহাম্মাদ বিন সীরীন রহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবী আবূ উবায়দাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু (মসজিদে সালাতের জন্য) আসলেন এবং লোকেরা সে সময় রুকূতে ছিলেন। তিনি (রুকূতে গিয়ে) হেঁটে এসে কাতারে শামিল হয়ে গেলেন। আর তিনি (সালাত শেষে) বললেন, তার পিতা এমনটিই করতেন।৮
তাহকীক: এই বর্ণনাটি মুনকাতি। কেননা আবূ উবায়দা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু স্বীয় পিতা হতে কোন কিছুই শ্রবণ করেন নি।
দলীল ১৬:
একটি বর্ণনায় এসেছে যে, আব্দুল আযীয বিন রুফাই রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি ইবনু মুগাফফাল মুযানী রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি বলেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
ولا تعتدوا بالسجود اذا لم تدركوا الركعة-
"যখন তোমরা রাকাআত পাবে না, তখন সিজদাকে গণ্য করবে না।"৯
তাহকীক: এই বর্ণনায় যদি ইবনু মুগাফফাল দ্বারা আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল আল মুযানী রহিমাহুল্লাহ উদ্দেশ্য হয়ে থাকেন, তাহলে জেনে রাখা উচিৎ যে, তার সাথে আব্দুল আযীয বিন রুফাই রহিমাহুল্লাহর সাক্ষাৎ হওয়ার কোন প্রমাণ নেই। আর যদি শাদ্দাদ বিন মাকিল রহিমাহুল্লাহকে বুঝানো হয়, তাহলে এই হাদীসের সনদটি মুনকাতি হিসেবে গণ্য হবে।
দলীল ১৭:
وَمَنْ أَدْرَكَ الرَّكْعَةَ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلَاةَ-
“যে ব্যক্তি রাকাআত পেলো, সে পুরো নামায পেয়ে গেলো।”১০
তাহকীক: বর্ণনাটির বুনিয়াদী রাবী ইয়াহইয়া বিন আবূ সুলায়মানকে ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এবং জমহূর মুহাদ্দিস যঈফ ও সমালোচিত অ্যাখ্যা দিয়েছেন। ইমাম ইবনু খুযায়মাহ রহিমাহুল্লাহও এই বর্ণনাটির ব্যাপারে সমালোচনা করেছেন। এছাড়াও এই বর্ণনাটির সকল শাওয়াহেদ যঈফ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহ ইসহাক বিন মানসূর মারওয়াযী রহিমাহুল্লাহর ‘মাসায়েলে আহমাদ ওয়া ইসহাক’ গ্রন্থ হতে এর একটি শাহেদ এনেছেন, যার বিষয়ে দুই ধরণের থেকে সমালোচনা রয়েছে-
(১) ইসহাক বিন মানসূর পর্যন্ত সহীহ সনদ অনুসন্ধান করা জরুরী। মুদ্রিত ‘মাসায়েলে আহমাদ ওয়া ইসহাক’ গ্রন্থে এই বর্ণনাটি পাওয়া যায় নি।
(২) আব্দুল আযীয বিন রুফাই রহিমাহুল্লাহর আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল হতে সাক্ষাতের প্রমাণও সন্ধান করতে হবে।
অর্থাৎ এই বর্ণনাটি স্বীয় সকল শাহেদ সহ যঈফ।
সারকথা: এ সম্পর্কে বর্ণিত সকল মারফূ বর্ণনা সনদগতভাবে যঈফ। বাকী রইলো সাহাবীদের আসার সমূহের বিষয়টি। তো এতে তাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
দ্বিতীয় দলের অভিমত:
কিছু আলেম বলেন যে, রুকূ পাওয়া ব্যক্তির রাকাআত হয় না, কেননা এতে দুটি ফরয বাদ পড়ে যায়- কিয়াম এবং সূরা ফাতেহা পাঠ করা। তাঁদের বক্তব্য হকের পক্ষে রয়েছে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَا تَفْعَلُوا إِلَّا بِأُمِّ القُرْآنِ ، فَإِنَّهُ لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِهَا -
“তোমরা স্রেফ উম্মুল কুরআন পাঠ করবে। কেননা যে তা পাঠ করল না তার কোনই সালাত নেই।”১১
ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এবং আরও অনেক জলীলুল কদর আলেম এর প্রবক্তা ছিলেন যে, রুকূ পেলেই রাকাআত হয়ে যায় না। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মাওলানা মুহাম্মাদ ইউনুস কুরায়শী রহিমাহুল্লাহ রচিত ‘ইতমামুল খুশূ বি আহকামি মুদরিকির রুকূ’ এবং মাওলানা মুহাম্মাদ মুনীর কামার হাফিযাহুল্লাহ প্রণীত ‘রুকূ মেঁ মিলনে ওয়ালে কী রাকআত : জানেবাঈন কে দালায়েল কা জায়েযাহ’ গ্রন্থদ্বয়।
[চলমান আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, রুকূ পেলে রাকাআত হয়ে যাবে মর্মে বর্ণিত কোনো বর্ণনা সহীহ সনদে প্রমাণিত নয়। বরং রাকাআত শুদ্ধ হওয়ার জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ আবশ্যক। তাই সূরা ফাতিহা পাঠ না করে কেবল রুকূ পেলে তা রাকাআত হিসেবে গণ্য হবে না।]*
(সমাপ্ত)
১. ইবনু আবী শায়বাহ, হা/২৬৩১, ১/২৫৬।
২. বায়হাকী, ২/৯০।
৩. মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৪৩৫, ৫/৪২।
৪. মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ, ১/২৪৩-২৪৪।
৫. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৬১৯, সনদ হাসান।
৬. উমদাতুল কারী, ৩/১৫৩।
৭. ইবনু আবী শায়বাহ, ১/২৪২।
৮. ইবনু আবী শায়বাহ, ১/২৫৫।
৯. মাসায়েলে আহমাদ ওয়া ইসহাক, ১/১২৭; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১১৮৮।
১০. সুনানে আবু দাঊদ, হা/৮৯৩।
১১. সুনানে আবূ দাঊদ, হা/৮২৩।
* সম্পাদক।