
বর্ষঃ ২ সংখ্যাঃ ২
ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
রুকূ পেলে রাকাআত হবে কীনা (পর্ব ১)
আহমাদুল্লাহ সৈয়দপুরী
মূল: শাইখ যুবায়ের আলী যাঈ
Views: 181
রুকূ পেলে রাকাআত হবে কীনা এই মাসআলায় আলেমদের দুটি অবস্থান রয়েছে। প্রথম অভিমত- উক্ত রাকাআতটি হয়ে যাবে, দ্বিতীয় অভিমত- উক্ত রাকাআতটি হবে না। প্রথম অভিমত প্রদানকারী আলেমদের দলীলসমূহের সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ পর্যালোচনা নিম্নরূপ:-
দলীল ১:
حَدَّثَنِي يَحْيَى بْنُ أَبِي سُلَيْمَانَ ، عَنْ زَيْدِ بْنِ أَبِي الْعَتَّابِ ، وَابْنِ الْمَقْبُرِيِّ ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ اذَا جِئْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ وَنَحْنُ سُجُوْدٌ فَاسْجُدُوْا ، وَلَا تَعُدُّوْهَا شَيْئًا ، وَمَنْ أَدْرَكَ الرَّكْعَةَ ، فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلَاة-
ইয়াহইয়া বিন আবূ সুলায়মান রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি যায়েদ বিন আবূ আত্তাব রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি সাঈদ মাকবুরী রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি আবূ হুরায়রা রহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যখন তোমরা নামাযের জন্য আসো এবং আমাদেরকে সিজদায় পাও তখন তোমরাও সিজদা করবে। আর সেই রাকাআতকে গণ্য করবে না। আর যে ব্যক্তি রাকাআত পেলো সে (মূলত পুরো) নামায পেয়ে গেলো।"১
তাহকীক:
(ক) ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এই বর্ণনার রাবী ইয়াহইয়া বিন আবূ সুলায়মান সম্পর্কে বলেছেন, “مُنْكَرُ الْحَدِيْثِ” "তিনি মুনকারুল হাদীস"।২
(খ) ইমাম ইবনু খুযায়মাহ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, "এই বর্ণনার ওপর হৃদয় প্রশান্ত হয় না। কেননা আমি ইয়াহইয়া বিন আবূ সুলায়মানকে জারাহ বা তাদীলের দৃষ্টিকোণ থেকে জানি না।"৩
(গ) উপরোক্ত রাবী ইয়াহইয়াকে জমহূর মুহাদ্দিস যঈফ বলেছেন। সুতরাং ইমাম হাকেম রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক তার বর্ণিত হাদীসকে সহীহ বলা প্রত্যাখ্যাত।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই বর্ণনা রুকূ পাওয়া ব্যক্তির পক্ষের দলীল নয়। বরং এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি (অন্তত এক) রাকাআত পেলো, সে নামায (অর্থাৎ অত্র নামাযের জামাআতটি) পেয়ে গেলো।
দলীল ২:
عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ ، عَنْ رَجُلٍ ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا جِئْتُمْ وَالْإِمَامُ رَاكِعٌ فَارْكَعُوا ، وَإِنْ كَانَ سَاجِدًا فَاسْجُدُوا ، وَلَا تَعْتَدُّوا بِالسُّجُودِ إِذَا لَمْ يَكُنْ مَعَهُ الرُّكُوعُ-
আব্দুল আযীয বিন রুফাই হতে, তিনি একজন ব্যক্তি হতে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেছেন যে, "যখন তোমরা আসো এবং ইমাম রুকূতে থাকে তখন রুকূ করো। যখন ইমাম সিজদায় থাকে তখন সিজদা করো। আর তার সাথে রুকূ না পাওয়া পর্যন্ত সিজদাকে গণ্য করবে না ।"৪
তাহকীক: এই বর্ণনায় ‘একজন ব্যক্তি’ হলেন মাজহূল (অপরিচিত)। আর এ কথাটির কোনো প্রমাণ নেই যে, তিনি সাহাবী।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ সুনানে বায়হাকী গ্রন্থের মধ্যে একটি বর্ণনায় "سُفْيَانُ ، عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ ، عَنْ شَيْخٍ مِنَ الْأَنْصَارِ-” "ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহিমাহুল্লাহ আব্দুল আযীয বিন রুফাই রহিমাহুল্লাহ হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আনসারের জনৈক শায়খ হতে বর্ণনা করেছেন" সনদটির ন্যায় মর্ম বর্ণিত আছে।৫
তাহকীক: এই বর্ণনাটির সনদ দুটি কারণে যঈফ -
প্রথমত, ইমাম সুফিয়ান সাওরী রহিমাহুল্লাহ একজন মুদাল্লিস রাবী ছিলেন। আর এই বর্ণনাটি হল মুআনআন।
দ্বিতীয়ত, আনসারের জনৈক শায়খ হলেন মাজহূল। আর "তিনি একজন সাহাবী" এ জাতীয় কথা বলা ভুল।
দলীল ৩:
يَحْيَى بْنِ حُمَيْدٍ ، عَنْ قُرَّةَ ، عَنِ ابْنِ شِهَابٍ ، عَنْ أَبِي سَلَمَةَ ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَة مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الصَّلَاةِ فَقَدْ أَدْرَكَهَا قَبْلَ أَنْ يُقِيْمَ الْإِمَامُ صُلْبَه-
ইয়াহইয়া বিন হুমাইদ রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি কুর্রাহ রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি ইবনু শিহাব রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি আবূ সালামাহ রহিমাহুল্লাহ হতে, তিনি আবূ হুরায়রা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "ইমাম তার পিঠকে উত্তোলন করার পূর্বেই যে (মুক্তাদী) নামাযের একটি রাকাআত পেলো, সে যেন উক্ত রাকাআত পেয়ে গেলো।"৬
তাহকীক:
(ক) এই বর্ণনাটির সনদ কুর্রাহ বিন আব্দুর রহমান বিন হায়বীল রহিমাহুল্লাহর কারণে যঈফ। রাবী কুর্রাহ রহিমাহুল্লাহ জমহূর মুহাদ্দিসের কাছে যঈফ। এই বর্ণনা সম্পর্কে শায়খ আমীনুল্লাহ পেশাওয়ারী বলেছেন, "এ হাদীসটির সনদ যঈফ।"৭
(খ) এই বর্ণনাটির আরেকটি সনদ রয়েছে। যেখানে মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত রাবী রয়েছেন। সুতরাং এই সনদটি খুবই দুর্বল।৮
দলীল ৪:
ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর অভিমত উদ্ধৃত করেছেন, مَنْ لَمْ يُدْرِكِ الْإِمَامَ رَاكِعًا لَمْ يُدْرِكْ تِلْكَ الرَّكْعَة-
"যে ব্যক্তি ইমামকে রুকূতে পেলো না, সে রাকাআতও পেলো না ।"৯
তাহকীক:
(ক) এই বর্ণনাটির সনদে আলী বিন আসেম রহিমাহুল্লাহ নামক একজন রাবী আছেন। যিনি জমহূর মুহাদ্দিসদের কাছে যঈফ ও সমালোচিত। সুতরাং এই বর্ণনাকে ‘এর সনদ সহীহ’ বলা ভুল।
(খ) এই বর্ণনাটির অন্য একটি সনদে আবূ ইসহাক আস সাবীঈ রহিমাহুল্লাহ নামক মুদাল্লিস রাবী আছেন। সুতরাং এই সনদটিও যঈফ। যতক্ষণ পর্যন্ত সনদ সহীহ ও হাসান না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ‘এ হাদীসটির রাবীগণ সিকাহ অ্যাখ্যাপ্রাপ্ত’ বলে কোনো লাভ নেই।
দলীল ৫:
ইমাম ইবনু আবী শায়বাহ রহিমাহুল্লাহ, ইমাম তাহাবী রহিমাহুল্লাহ এবং ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রুকূ পাওয়া ব্যক্তিকে রাকাআত পাওয়া ব্যক্তি বলে মনে করতেন ।১০
তাহকীক: এ হাদীসটির সনদ সহীহ। কিন্তু এটি একজন সাহাবীর ফাতাওয়া মাত্র।
দলীল ৬:
ইমাম ইবনু আবী শায়বাহ রহিমাহুল্লাহ বিখ্যাত সাহাবী ইবনু ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে তার ফাতাওয়া উদ্ধৃত করেছেন। যার সারকথা হল যে, তিনি রুকূ পাওয়া ব্যক্তিকে রাকাআত পেয়েছে মর্মে মনে করতেন।১১
তাহকীক:
(ক) এই বর্ণনাটির সনদ ইমাম হাফস রহিমাহুল্লাহ এবং ইমাম ইবনু জুরাইজ রহিমাহুল্লাহর তাদলীসের কারণে যঈফ।
(খ) ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহর সুনানুল কুবরার একটি যঈফ শাহেদও আছে।১২ তাতে রাবী ওয়ালীদ বিন মুসলিম রহিমাহুল্লাহ রয়েছেন, যিনি তাদলীসে তাসবিয়াও করতেন এবং ধারাবাহিকভাবে সামা তথা হাদীস শ্রবণের বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতেন না।
দলীল ৭:
ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ সাহাবী যায়েদ বিন সাবিত রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু এবং সাহাবী ইবনু ওমর রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, مَنْ أَدْرَكَ الرَّكْعَةَ قَبْلَ أَنْ يَرْفَعَ الْإِمَامُ رَأْسَهُ فَقَدْ أَدْرَكَ السَّجْدَةَ-
"যে ব্যক্তি ইমামের মাথা উত্তোলন করার পূর্বেই রুকূ পেলো, সে সিজদা পেয়ে গেলো।"১৩ অর্থাৎ সেই ব্যক্তি রাকাআত পেয়ে গেলো।
তাহকীক:
(ক) এই বর্ণনাটির সনদ ইনকিতা বা বিচ্ছিন্নতার কারণে যঈফ। ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ এটা বলেননি যে, এই বর্ণনা কোন সূত্রে তার কাছে এসে পৌঁছেছে।
(খ) এই মাওকূফ বর্ণনাটির অন্যান্য সনদও আছে। এই আসারগুলির মোকাবেলায় ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,
حَدَّثَنَا عُبَيْدُ بْنُ يَعِيشَ ، قَالَ : حَدَّثَنَا يُونُسُ ، قَالَ : حَدَّثَنَا ابْنُ إِسْحَاقِ ، قَالَ : قَالَ : أَخْبَرَنِي الْأَعْرَجُ ، قَالَ : سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ يَقُولُ : لَا يُجْزِئُكَ إِلَّا أَنْ تُدْرِكَ الْإِمَامَ قَائِمًا قَبْلَ أَنْ يَرْكَعَ-
উবাইদ বিন ইয়াঈশ রহিমাহুল্লাহ আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আমাদেরকে ইউনুস রহিমাহুল্লাহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আমাদেরকে ইবনু ইসহাক রহিমাহুল্লাহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আমাকে আরাজ রহিমাহুল্লাহ সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি বলেন, আমি আবূ হুরায়রা রাযিআল্লাহু আনহুকে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেন, "তোমার রাকাআত ততক্ষণ পর্যন্ত সিদ্ধ হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ইমামকে রুকূর পূর্বে কিয়াম অবস্থায় না পাও।"১৪
(গ) প্রখ্যাত সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রাযিআল্লাহু আনহু বলেছেন, لَا يَرْكَعْ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَقْرَأَ بِأُمِّ الْقُرْآنِ-
"সূরা ফাতিহা পাঠ করা ব্যতীত তোমাদের কেউ যেন রুকূ না করে।"১৫
প্রতীয়মান হলো যে, এই মাসআলায় সাহাবীদের মধ্যে ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য রয়েছে। যখন সাহাবীদের মাঝে ইখতিলাফ হবে তখন কিতাব ও সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হুকুম করা হয়েছে।
চলবে...
১. আবূ দাঊদ, হা/৮৯৩; ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৬২২, তিনি একে ত্রুটিযুক্ত বলেছেন এবং সহীহ বলেননি; হাকেম, ১/২১৬, ২৭৩, ২৭৬; দারাকুতনী, হা/১২৯৯, ১/৩৪৭; বায়হাকী, ২/৮৮
২. জুযউল কিরাআত, হা/২৩৯
৩. সহীহ ইবনু খুযায়মাহ, ৩/৫৭, ৫৮; নাসরুল বারী, পৃ: ২৬২
৪. বায়হাকী, ২/৮৯
৫. বায়হাকী, ২/২৯৬
৬. দারাকুতনী, হা/১২৯৮, ১/৩৪৬; জুযউল কিরাআত, হা/২০৮; ইবনু খুযায়মাহ, হা/১৫৯৫; বায়হাকী, ২/৮৯; উকায়লী, ৪/৩৯৮; ইবনু আদী, ৭/২৬৮৪
৭. ফাতাওয়া আদ দ্বীনুল খালেস, ৪/২১৮
৮. ফাতাওয়া আদ দ্বীনুল খালেস, ৪/২১৮
৯. বায়হাকী, ২/৯০
১০. ইবনু আবী শায়বাহ, ১/৯৯; তাহাবী, ১/২২৩; বায়হাকী, ২/৯০
১১. ইবনু আবী শায়বাহ, ১/২৪৩
১২. বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, ২/৯০
১৩. বায়হাকী, ২/৯০
১৪. জুযউল কিরাআত, হা/১৩২, সনদ হাসান; নাসরুল বারী, পৃ: ১৮২-১৮৩
১৫. জুযউল কিরাআত, হা/১৩৩, সনদ সহীহ