কাবলাল জুমআ (পর্ব ২)

বর্ষঃ ১ সংখ্যাঃ ৫
মে, ২০২৪

কাবলাল জুমআ (পর্ব ২)

আহমাদুল্লাহ সৈয়দপুরী

Views: 131

Share:

১. মারফূ দলীলসমূহ:

দলীল ৪: حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ سَعِيدٍ الرَّازِيُّ قَالَ : نا سُلَيْمَانُ بْنُ عُمَرَ بْنِ خَالِدٍ الرَّقِّيُّ قَالَ : نا عَتَّابُ بْنُ بَشِيرٍ، عَنْ خُصَيْفٍ، عَنْ أَبِي عُبَيْدَةَ، عَنْ عَبْدِ اللهِ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا.
আমাদেরকে আলী বিন সাঈদ আর রাযী হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সুলায়মান বিন ওমর বিন খালেদ আর রাক্কী আমাদেরকে খবর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আত্তাব বিন বাশীর আমাদেরকে সংবাদ প্রদান করেছেন খুসাইফ হতে, তিনি আবূ উবায়দাহ হতে, তিনি আব্দুল্লাহ হতে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি জুমআর পূর্বে চার রাকাআত এবং পরে চার রাকাআত পড়তেন।
তাখরীজ: তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত, হা/৩৯৫৯। ইমাম তাবারানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, لَمْ يَرْوِ هَذَا الْحَدِيثَ عَنْ خُصَيْفٍ إِلَّا عَتَّابُ بْنُ بَشِير “খুসাইফ হতে এই হাদীসটি আত্তাব বিন বাশীর ব্যতীত আর কেউই বর্ণনা করেন নি।”
তাহকীক: যঈফ। হাদীসটি যঈফ ২টি কারণে।
১ম কারণ: অত্র হাদীসের সনদের ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম বলেন-
(ক) ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ বলেন,  وَعَن بن مَسْعُودٍ عِنْدَ الطَّبَرَانِيِّ أَيْضًا مِثْلُهُ وَفِي إِسْنَادِهِ ضعف وَانْقِطَاع“ইবনে মাসউদ হতে তাবারানীর নিকটেও অনুরূপ (একটি বর্ণনা আছে)। এই সনদটির মধ্যে দুর্বলতা ও বিচ্ছিন্নতা আছে।”

(খ) আব্দুর রহমান মোবারকপুরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, عن بن مَسْعُودٍ مَرْفُوعًا وَفِي إِسْنَادِهِ ضَعْفٌ وَانْقِطَاعٌ كَذَا فِي فَتْحِ الْبَارِي- “ইবনে মাসউদ হতে মারফূ হিসেবে বর্ণিত। আর এর সনদে দুর্বলতা ও বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। যেমনটি ফাতহুল বারী গ্রন্থে আছে।”

(গ) আলবানী রহিমাহুল্লাহ এ হাদীসটিকে মুনকার বলেছেন।

দ্বিতীয় কারণ: এই হাদীসটির রাবী খুসাইফ জমহূর মুহাদ্দিসদের নিকটে যঈফ।
(ক) ইবনে আবী হাতেম রহিমাহুল্লাহ৪ এবং ইবনে হিব্বান রহিমাহুল্লাহ তার সমালোচনা করেছেন।

(খ) হাফেয যাহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, صدوق سئ الحفظ ضعفه أحمد- “তিনি সত্যবাদী। মন্দ হিফযের অধিকারী। আহমাদ তাকে যঈফ বলেছেন।” তিনি অন্যত্র বলেন, “খুসাইফ বিন আব্দুর রহমান আল জাযারী তাবেঈনদের থেকে অত্যধিক বর্ণনাকারী। আহমাদ এবং অন্যরা তাকে যঈফ বলেছেন।”

(গ) হাফেয বুরহানুদ্দীন হালাবী তাকে মস্তিষ্ক বিকৃত রাবীদের গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।

(ঘ) হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, صدوق سيء الحفظ خلط بأخرة ورمي بالإرجاء من الخامسة- “তিনি সত্যবাদী। মন্দ হিফযের অধিকারী। শেষ বয়সে মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তাকে মুরজী হওয়ার অপবাদ দেয়া হয়েছিল। তিনি পঞ্চম স্তরভুক্ত।”

(ঙ) বদরুদ্দীন আইনী হানাফী রহিমাহুল্লাহ তার কতিপয় ওস্তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেখানে তিনি ইবনে মাসউদ রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুর নাম বলেননি।১০

(চ) দারাকুতনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, خصيف بن عبد الرحمن جزري يعتبر به، يهم- “তার বর্ণনার জন্য ইতিবার করা হয় (তার বর্ণনা কবুল করা যাবে কীনা মর্মে গবেষণা করা হয়)। তিনি ভুল করতেন।”১১

(ছ) হাফেয যায়লাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, وَابْنُ إسْحَاقَ، وَخُصَيْفٌ فِيهِمَا مَقَالٌ- “ইবনে ইসহাক এবং খুসাইফ সম্পর্কে সমালোচনা রয়েছে।”১২ তিনি আরও বলেন, وَخُصَيْفُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْجَزَرِيُّ ضَعَّفَهُ بَعْضُهُمْ- “খুসাইফ বিন আব্দুর রহমান আল জাযারীকে কতিপয় মুহাদ্দিস যঈফ বলেছেন।”১৩

(জ) হাফেয ইবনে কাসীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, وفي إسناده: خصيف بن عبد الرحمن الجزري، وقد اختلف فيه- “হাদীসের সনদে খুসাইফ আছেন। তার সম্পর্কে ইখতিলাফ আছে।”১৪

(ঝ) ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহ বলেন, خُصَيْفٌ الْجَزَرِيُّ غَيْرُ قَوِيٍّ- "খুসাইফ শক্তিশালী রাবী নন।“১৫

(ঞ) ইমাম নাসাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, خصيف بن عبد الرَّحْمَن لَيْسَ بِالْقَوِيّ- “খুসাইফ বিন আব্দুর রহমান শক্তিশালী রাবী নন।“১৬

দলীল ৫: حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ، أَخْبَرَنَا أَيُّوبُ، عَنْ نَافِعٍ، قَالَ : كَانَ ابْنُ عُمَرَ يُطِيلُ الصَّلَاةَ قَبْلَ الْجُمُعَةِ، وَيُصَلِّي بَعْدَهَا رَكْعَتَيْنِ فِي بَيْتِهِ، وَيُحَدِّثُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَفْعَلُ ذَلِكَ
মুসাদ্দাদ আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তিনি বলেছেন) ইসমাঈল আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তিনি বলেছেন) আইয়ূব আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন নাফে হতে। তিনি বলেছেন, “ইবনে ওমর রাযিআল্লাহু আনহু জুমআর পূর্বে দীর্ঘ নামায পড়তেন এবং তিনি জুমআর নামাযের পরে নিজের বাসায় ২ রাকাআত নামায পড়তেন। আর বলতেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটি করতেন।”
তাখরীজ: আবূ দাঊদ হা/১১২৮।
তাহকীক: ইমাম নাসিরুদ্দীন আলবানী বলেন,
 وأما قوله : "كان يطيل الصلاة قبل الجمعة" فإن كان المراد بعد دخول الوقت فلا يصح أن يكون مرفوعا لأنه صلى الله عليه وسلم كان يخرج إذا زالت الشمس فيشتغل بالخطبة ثم بصلاة الجمعة وإن كان المراد قبل دخول الوقت فذلك مطلق نافلة لا صلاة راتبة فلا حجة فيه لسنة الجمعة التي قبلها بل هو نفل مطلق وقد ورد الترغيب فيه كما تقدم في حديث سلمان وغيره حيث قال فيه: ثم صلى ما كتب له-
আর তার উক্তি 'তিনি জুমআর পূর্বে দীর্ঘ সালাত পড়তেন' দ্বারা যদি ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পরের সময়টি উদ্দেশ্য হয়, তবে এর মারফূ হওয়া সহীহ নয়। কেননা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্য হেলে যাওয়ার পরে (ঘর থেকে) বের হতেন। এরপর তিনি খুতবা, অতঃপর জুমআর সালাতে মগ্ন হতেন। আর যদি ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পূর্বে উদ্দেশ্য হয়, তবে সেটি দ্বারা শর্তবিহীন নফল নামাযকে বোঝানো হয়েছে, নিয়মিত সুন্নাত নামাযকে নয়। ফলে জুমআর পূর্বের (চার রাকাআত নির্দিষ্ট) সুন্নাতের পক্ষে কোন দলীল এতে নেই। বরং এটি একটি সাধারণ তথা শর্তহীন নফল সালাত। এ সম্পর্কে উৎসাহ প্রদান করা বর্ণিত হয়েছে। যেমনটি সালমান এবং অন্যদের বর্ণিত হাদীসের মধ্যে আলোচিত হয়েছে। যেমনভাবে তিনি বলেছেন, “অতঃপর সে ততটুকু নামায পড়বে যা ভাগ্যে লেখা হয়েছে (যতটুকু তার সাধ্যে থাকে)।“১৭

বস্তুতঃ এ হাদীসে সময় নির্দিষ্ট করা হয়নি এবং জুমআর পূর্বে চার রাকাআত সুন্নাত নামায নিয়মিত পড়তে হবে মর্মেও কোন ইশারা এখানে নেই। হানাফী মাহযাবের ভাইগণ প্রথমে বাংলায় আলোচনা করেন। এরপর চার রাকাআত সুন্নাত নির্ধারিতভাবে পড়েন। অতঃপর আরবীতে খুতবা প্রদানের পর জুমআর সালাত আদায় করেন। কোন হাদীসেই এমন আমলের অস্তিত্ব আছে বলে আমাদের জানা নেই। ইমাম আবূ হানীফা রহিমাহুল্লাহও এমন কোন আমল করেছেন বা করতে বলেছেন মর্মে কোন বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত পাওয়া যায় না।

দলীল ৬:  حَدَّثَنَا أَبُو مُوسَى مُحَمَّدُ بْنُ المثَنَّى قَالَ : حَدَّثَنَا أَبُو دَاوُدَ الطَّيَالِسِيُّ قَالَ : حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ مُسْلِمِ بْنِ أَبِي الوَضَّاحِ هُوَ أَبُو سَعِيدٍ المؤَدِّبُ، عَنْ عَبْدِ الكَرِيمِ الجَزَرِيِّ، عَنْ مُجَاهِدٍ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي أَرْبَعًا بَعْدَ أَنْ تَزُولَ الشَّمْسُ قَبْلَ الظُّهْرِ، وَقَالَ : إِنَّهَا سَاعَةٌ تُفْتَحُ فِيهَا أَبْوَابُ السَّمَاءِ، وَأُحِبُّ أَنْ يَصْعَدَ لِي فِيهَا عَمَلٌ صَالِحٌ وَفِي البَابِ عَنْ عَلِيٍّ، وَأَبِي أَيُّوبَ : حَدِيثُ عَبْدِ اللهِ بْنِ السَّائِبِ حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ وَرُوِيَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ يُصَلِّي أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ بَعْدَ الزَّوَالِ، لَا يُسَلِّمُ إِلَّا فِي آخِرِهِنَّ-
আবূ মূসা মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তিনি বলেছেন) আবূ দাঊদ (আত তায়ালিসী) আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তিনি বলেছেন) মুহাম্মাদ বিন মুসলিম বিন আবুল ওয়াযযাহ আবূ সাঈদ আল মুওয়াদ্দিব আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আব্দুল করীম আল-জাযারী হতে, তিনি মুজাহিদ হতে, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনুস সায়েব হতে যে, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যোহরের পূর্বে অর্থাৎ যোহরের ফরযের আগে, সূর্য ঢলে যাওয়ার পরে চার রাকাআত পড়তেন। তিনি বলেছেন, এটি সেই মুহুর্ত যে সময় আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আমি পছন্দ করি যে, আমার এই সময় আমলে সালেহ ঊর্দ্ধে ওঠানো হোক।“
তাখরীজ: তিরমিযী হা/৪৭৮; মিশকাত হা/১১৬৯।
তাহকীক: হাদীসটি সহীহ। কিন্তু এর দ্বারা জুমআর পূর্বে খাসভাবে চার রাকাআত সুন্নাত আদায় করা প্রমাণিত হয় না। এবিষয়ে ওলামায়ে কেরাম বলেন-
(ক) মোল্লা আলী কারী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেন, وَتِلْكَ الرَّكَعَاتُ الْأَرْبَعُ سُنَّةُ الظُّهْرِ الَّتِي قَبْلَهُ، كَذَا قَالَهُ بَعْضُ الشُّرَّاحِ مِنْ عُلَمَائِنَا- “এই চার রাকাআত হল যোহরের পূর্বের সুন্নাত। যেমনটি আমাদের কতিপয় ব্যাখ্যাকারী আলেম বলেছেন।”১৮

(খ) আল্লামা ওবায়দুল্লাহ মোবারকপুরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, أي قبل فرضه وهل هي سنة الزوال أو سنة الظهر القبلية؟ فيه خلاف علم مما نقدم. "অর্থাৎ ফরযের পূর্বে। এটি কি সুন্নাতুয যাওয়াল নাকি যোহরের পূর্বের সুন্নাত? এ মর্মে মতানৈক্য রয়েছে।“১৯

(গ) ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ এ হাদীসটিকে ‘যোহর-এর সুন্নাত’ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন।

মোটকথা, যোহরের পূর্বে চার রাকাআত আদায় করা সুন্নাত, জুমআর পূর্বে নয়। খুতবার পূর্বে চার রাকাআত আদায় করা যাবে নফল হিসেবে। শুধু চার রাকাআত নয়, বরং সময় থাকার শর্তে যত ইচ্ছা নফল নামায পড়া যাবে, কোন নির্দিষ্ট রাকাআত সংখ্যা নেই।

চলবে...


১. ফাতহুল বারী ২/৪২৬
২. তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৪৮
৩. সিলসিলা যঈফাহ হা/১০১৬
৪. আল জারহু ওয়াত তাদীল, রাবী নং ১৮৪৮
৫. আল মাজরূহীন, রাবী নং ৩১৫
৬. আল কাশিফ, রাবী নং ১৩৮৯
৭. আল মুগনী, রাবী নং ১৯১২
৮. আল ইগতিবাত, রাবী নং ৪৩/৪
৯. তাকরীবুত তাহযীব, রাবী নং ১৭১৮
১০. মাগানিউল আখয়ার, রাবী নং ৫৯৮
১১. মাওসূআতু আকওয়ালিল ইমাম আবীল হাসান আদ দারাকুতনী, রাবী নং ১১৭৬
১২. নাসবুর রায়াহ ৩/২১
১৩. নাসবুর রায়াহ ৩/২১
১৪. তুহফাতুত তালিব, পৃ: ৫২
১৫. সুনানুল কুবরা হা/৮৯৭৯
১৬. আয যুআফাউল মাতরূকূন, রাবী নং ১৭৭
১৭. আল আজবিবাতুন নাফেআহ, পৃ: ৫৮
১৮. মিরকাতুল মাফাতীহ হা/১১৬৯-এর ব্যাখ্যা দ্র.
১৯. মিরআতুল মাফাতীহ হা/১১৭৬-এর ব্যাখ্যা দ্র.