বর্ষঃ ১ সংখ্যাঃ ৪
এপ্রিল, ২০২৪
কাবলাল জুমআ (পর্ব ১)
আহমাদুল্লাহ সৈয়দপুরী
Views: 218
ভূমিকা: জুমআর সাথে সম্পৃক্ত কয়েকটি বিষয় নিয়ে ইখতেলাফ রয়েছে। তন্মধ্যে কাবলাল জুমআ তথা জুমআর পূর্বে নির্দিষ্টভাবে চার রাকাআত সুন্নাত নামায আদায় করার বিষয়টি অন্যতম। এ সম্পর্কে অনেকেই একাধিক দলীলও পেশ করেছেন। মূলত জুমআর পূর্বে ইচ্ছামত নফল নামায পড়া যায়। এ ব্যাপারে কোন ধরাবাঁধা সংখ্যা নেই। অত্র প্রবন্ধে পাঠকদের সমীপে কাবলাল জুমআর পক্ষে উপস্থাপিত দলীলসমূহের তাহকীক ও তাখরীজ পেশ করবো ইনশাআল্লাহ।
১. মারফূ দলীলসমূহ:
দলীল ১: حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ يَحْيَى قَالَ : حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ عَبْدِ رَبِّهِ قَالَ: حَدَّثَنَا بَقِيَّةُ، عَنْ مُبَشِّرِ بْنِ عُبَيْدٍ، عَنْ حَجَّاجِ بْنِ أَرْطَاةَ، عَنْ عَطِيَّةَ الْعوفِيِّ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَرْكَعُ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، لَا يَفْصِلُ فِي شَيْءٍ مِنْهُنَّ.
আমাদেরকে মুহাম্মাদ বিন ইয়াহইয়া হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদেরকে ইয়াযীদ বিন আব্দু রব্বিহ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বাকিইয়্যাহ হাদীস বর্ণনা করেছেন মুবাশশির বিন উবাইদ হতে। তিনি বর্ণনা করেছেন হাজ্জাজ বিন আরতাত হতে। তিনি বর্ণনা করেছেন আতিইয়্যাহ আওফী হতে। তিনি হাদীসটি ইবনে আব্বাস হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি (ইবনে আব্বাস) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর পূর্বে চার রাকাআত আদায় করতেন, মাঝে কোন সালাম ফেরাতেন না।“
তাখরীজ: ইবনে মাজাহ হা/১১২৯; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর হা/১৬৪০।
তাহকীক:
(ক) শাইখ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহিমাহুল্লাহ এই হাদীসকে বাতিল বলেছেন। তিনি বলেন, “এটি তাবারানী তার আল মুজামুল কাবীর (৩/১৭২) গ্রন্থে (বাকিইয়্যাহ ইবনুল ওয়ালীদ হতে) মারফূ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটিকে ইবনে মাজাহ তার সুনান গ্রন্থে (১/৩৪৭) উক্ত সূত্রেই বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি ‘জুমআর পরে চার রাকাআত’-এ অংশটুকু ব্যতীত বর্ণনা করেছেন। হাফেয যায়লাঈ নাসবুর রায়াহ (২/২০৬) গ্রন্থে বলেছেন, এর সনদটি খুবই দুর্বল। মুবাশশির বিন উবাইদকে হাদীস জালকারীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। আর হাজ্জাজ ও আতিইয়্যাহ উভয়েই দুর্বল।”১
(খ) হাফেয যায়লাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, وَسَنَدُهُ وَاهٍ جِدًّا، فَمُبَشِّرُ بْنُ عُبَيْدٍ مَعْدُودٌ فِي الْوَضَّاعِينَ، وَحَجَّاجٌ وَعَطِيَّةُ ضَعِيفَانِ. “এই সনদটি খুবই দুর্বল। মুবাশশির বিন উবাইদকে হাদীস জালকারীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। আর হাজ্জাজ ও আতিইয়্যাহ উভয়েই দুর্বল রাবী।”২
(গ) ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, رَوَاهُ ابْن ماجة بِإِسْنَاد ضَعِيف جد. “ইবনে মাজাহ একে অত্যন্ত যঈফ সনদে বর্ণনা করেছেন।”৩ অন্যত্র তিনি বলেন, رَوَاهُ ابْن مَاجَه. وَهُوَ حَدِيث بَاطِل اجْتمع فِيهِ هَؤُلَاءِ الْأَرْبَعَة، وهم ضعفاء، ومبشر وضّاع صَاحب أباطيل. “ইবনে মাজাহ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। আর এই হাদীসটি বাতিল। এখানে এই চারজন যঈফ রাবী একত্র হয়েছেন। আর মুবাশশির হলেন হাদীস জালকারী, বাতিল রেওয়ায়াত বর্ণনাকারী।”৪
(ঘ) বদরুদ্দীন আইনী হানাফী রহিমাহুল্লাহ বলেন, وسنده واهِ جداً؛ لأن فيه مبشر ابن عبيد وهو معدود في الوضاعين، وفيه حجاج وعطية وهما ضعيفان. “এর সনদটি খুবই দুর্বল। কেননা এখানে মুবাশশির বিন উবাইদ আছেন। আর তাকে হাদীস জালকারীদের মধ্যে গণ্য করা হয়। এছাড়াও এখানে হাজ্জাজ ও আতিইয়্যাহ নামক দুজন রাবী রয়েছেন, উভয়ই যঈফ।”৫
দলীল ২: حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ عَبْدِ الْبَاقِي الْمِصِّيصِيُّ، ثنا عَمْرُو بْنُ عُثْمَانَ الْحِمْصِيُّ، ثنا بَقِيَّةُ بْنُ الْوَلِيدِ، عَنْ مُبَشِّرِ بْنِ عُبَيْدٍ، عَنِ الْحَجَّاجِ بْنِ أَرْطَاةَ، عَنْ عَطِيَّةَ الْعَوْفِيِّ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ : كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَرْكَعُ قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا لَا يَفْصِلُ بَيْنَهُنَّ.
ইয়াহইয়া বিন আব্দুল বাকী আল মিসসীসী আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তিনি বলেছেন) আমর বিন ওসমান আল হিমসী আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তিনি বলেছেন) বাকিইয়্যাহ ইবনুল ওয়ালীদ আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন মুবাশশির বিন উবাইদ হতে, তিনি হাজ্জাজ বিন আরতাত হতে, তিনি আতিইয়্যাহ আল আওফী হতে, তিনি ইবনে আব্বাস হতে (বর্ণনা করেছেন)। তিনি (ইবনে আব্বাস) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর পূর্বে চার রাকাআত পড়তেন, মাঝে কোন সালাম ফেরাতেন না।“
তাখরীজ: তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর হা/১২৬৭৪।
তাহকীক: এটাও বানোয়াট হাদীস। কেননা এর সনদে মুবাশশির বিন উবাইদ নামক উপরোল্লিখিত মহামিথ্যুক রাবী রয়েছেন। এতদ্ভিন্ন এখানে বাকিইয়্যাহ ইবনুল ওয়ালীদ, হাজ্জাজ বিন আরতাত এবং আতিইয়্যাহ আল-আওফী রয়েছেন। যাদের সম্পর্কে উপরে আলোচিত হয়েছে।
দলীল ৩: حَدَّثَنَا أَحْمَدُ قَالَ : نا شَبَابٌ الْعُصْفُرِيُّ قَالَ : نا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ السَّهْمِيُّ قَالَ : نا حُصَيْنُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ السَّلَمِيُّ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ ضَمْرَةَ، عَنْ عَلِيٍّ قَالَ : كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي قَبْلَ الْجُمُعَةِ أَرْبَعًا، وَبَعْدَهَا أَرْبَعًا، يَجْعَلُ التَّسْلِيمَ فِي آخِرِهِنَّ رَكْعَةً .
আমাদেরকে আহমাদ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদেরকে শাবাব উসফুরী খবর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান আস সাহমী আমাদেরকে খবর প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, হুসাইন বিন আব্দুর রহমান আস সুলামী আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন আবূ ইসহাক হতে, তিনি আসেম বিন যামরাহ হতে, তিনি আলী হতে। তিনি (আলী রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমআর পূর্বে চার রাকাআত এবং পরে চার রাকাআত পড়তেন, চার রাকাআতের শেষে সালাম ফেরাতেন।“
তাখরীজ: তাবারানী, আল মুজামুল আওসাত হা/১৬১৭।
তাহকীক: হাদীসটি যঈফ।
(ক) ইমাম তাবারানী রহিমাহুল্লাহ হাদীসটির শেষে বলেছেন, لَمْ يَرْوِ هَذَا الْحَدِيثَ عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ إِلَّا حُصَيْنٌ، وَلَا رَوَاهُ عَنْ حُصَيْنٍ إِلَّا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ السَّهْمِيُّ. “কেবল হুসাইন এই হাদীসটি আবূ ইসহাক হতে বর্ণনা করেছেন। আর হুসাইন হতে শুধু মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান আস সাহমী এটা বর্ণনা করেছেন।“৬
মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান আস সাহমী সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের অভিমত নিম্নরূপ:
(i) আলবানী রহিমাহুল্লাহ তাকে মুনকার বলেছেন।৭
(ii) ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ السَّهْمِيُّ وَهُوَ ضَعِيفٌ عِنْدَ الْبُخَارِيِّ وَغَيْرِهِ وَقَالَ الْأَثْرَمُ إِنَّهُ حَدِيثٌ واه. “বুখারী ও অন্যদের মতানুযায়ী মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান আস সাহমী যঈফ। আসরাম বলেছেন, তার বর্ণিত হাদীস অত্যন্ত দুর্বল।"৮
(iii) ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ولا يُتابَعُ عليه “তাকে সমর্থন করা হয় না”।৯
সুতরাং জমহুর মুহাদ্দিসগণের মতে তিনি যঈফ।
অপর রাবী আবূ ইসহাক রহিমাহুল্লাহ একজন প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস রাবী। তিনি সিকাহ-মুদাল্লিস রাবী। তার সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের অভিমত নিম্নরূপ:
(i) كثير التدليس ويعرف بالإمام “তিনি ইমামগণের নিকট অত্যধিক তাদলীসকারী হিসেবে পরিচিত”।১০
(ii) ইবনে হাজার আসকালানী রহিমাহুল্লাহ তাঁকে স্বীয় ‘তাবাকাতুল মুদাল্লিসীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।১১
(iii) ‘যিকরুল মুদাল্লিসীন’১২, ‘আল মুদাল্লিসীন’১৩ প্রভৃতি গ্রন্থে তাকে প্রসিদ্ধ মুদাল্লিস রাবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
(iv) ইমাম নাসিরুদ্দীন আলবানী রহিমাহুল্লাহ তাঁকে মুদাল্লিস রাবী বলেছেন।১৪ অন্যত্র তিনি বলেন, الثانية : أبو إسحاق السبيعي، ثقة ولكنه على اختلاطه مدلس. “দ্বিতীয়ত, আবূ ইসহাক আস সাবীঈ আস্থাভাজন। কিন্তু ইখতিলাত থাকার সাথে সাথে তিনি মুদাল্লিসও ছিলেন।"১৫
(খ) শাইখ যুবায়ের আলী যাঈ রহিমাহুল্লাহ বলেন, “এই বর্ণনাটি যঈফ। কারণ:
(i) আবূ ইসহাক আস সাবীঈ মুদাল্লিস রাবী।১৬
(ii) আবূ ইসহাক শেষ বয়সে ইখতিলাতের শিকার হয়েছিলেন।১৭
চলবে...
১. সিলসিলা যঈফা হা/১০০১
২. নাসবুর রায়াহ ২/২০৬
৩. খুলাসাতুল আহকাম হা/১৮৫১
৪. খুলাসাতুল আহকাম হা/২৮৭২
৫. শরহে আবূ দাঊদ হা/১০৯৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; উমদাতুল কারী হা/৯৩৩৭-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য
৬. আল মুজামুল আওসাত হা/১৬১৭
৭. সিলসিলা যঈফা হা/৫২৯০
৮. ফাতহুল বারী ২/৪২৬
৯. আত তারীখুল কাবীর, রাবী নং ৪৮১; আল মুগনী, রাবী নং ৫৭২৭
১০. আসমাউল মুদাল্লিদীন, রাবী নং ৪৫
১১. তাবাকাতুল মুদাল্লিদীন, রাবী নং ৯১
১২. যিকরুল মুদাল্লিসীন, রাবী নং ৯
১৩. আল মুদাল্লিসীন, রাবী নং ৪৭
১৪. সিলসিলা সহীহা হা/১৭০১
১৫. সিলসিলা সহীহা, হা/২০৩৫
১৬. সহীহ ইবনে হিব্বান, আল ইহসান ১/৯০; তাবাকাতুল মুদাল্লিসীন (শাইখ যুবায়ের আলী যাঈ তাহকীককৃত), পৃ: ৫৮
১৭. ফাতাওয়া ইলমিইয়া ১/৪৪৮